নিজস্ব প্রতিবেদক:
১৯৭১’র ১৬ই ডিসেম্বর। যুদ্ধজয়ী বীর যখন ঘরে ফিরছিলেন তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। শান্তিনগর মোড়ে বাসা। সেখানে গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলেন বাবাকে। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। বাবা তাকে বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘ওরে খোকা তুই বেঁচে আছিস…’ খোকা ঝুঁকে পড়ে বাবাকে কদমবুসি করলো। সাথে থাকা অন্য যুদ্ধফেরত বীরেরাও কদমবুসি করলেন আকুল অপেক্ষায় থাকা এক পিতাকে। এমনটাই ছিলো তার ঘরে ফেরা।
প্রিয় পাঠক, আমরা বলছি বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা গোলাম দস্তগীর গাজীর কথা। মুক্তিযুদ্ধে যার বীরত্বগাঁথা এখন জানা। জাতি তাকে বীরত্বের খেতাব দিয়ে সম্মান দেখিয়েছে। ঢাকা অ্যাটাকে ক্র্যাক প্লাটুনের এই অন্যতম সদস্য তার সাহসিকতার স্বীকৃতিতে পেয়েছেন বীর প্রতীক উপাধি।
দেশের জন্য, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন। ঘর ছেড়ে কাটিয়েছেন বনে-বাঁদারে। পথে ঘাটে। এসএলআর, স্টেনগান হাতে যুদ্ধ করেছেন। হত্যা করেছেন অনেক শত্রুসেনা। বিস্ফোরক, ডেটোনেটর দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন পাওয়ার স্টেশন, ব্রিজ, বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ আরো ছোট-বড় অনেক স্থাপনা, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
মুখোমুখি হয়েছিলেন এই যোদ্ধা। শোনাচ্ছিলেন যুদ্ধজযের কাহিনী। বলছিলেন, কিভাবে সংগঠিত হয়েছিলেন। কিভাবে কোন পথে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে অভুক্ত থেকে পৌঁছেছিলেন আগড়তলা। সেখানে অস্ত্র চালানো শিখে ফের দেশে ঢুকে যুদ্ধ করে করে ক্রমে ঢাকার পথে এগিয়ে এসেছিলেন।
বললেন, যুদ্ধ যতটা না সাহসের তার চেয়ে অনেক বেশি কৌশলের। আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। আর সে জন্যই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। আর সে কৌশল নিয়েই আমরা কখনো পিছু হটেছি। কখনো সামনে এগিয়েছি।
নয় মাসের প্রায় পুরো সময়টি ধরে যুদ্ধ করে চলা এই বিজয়ী বীর বললেন, প্রথম দিকে যুদ্ধ করাটা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিলো। পরের দিকে তা কঠিন হয়ে ওঠে। প্রথম দিকে আশ্রয় পাওয়া যেতো, গ্রামবাসীও ততটা ভয় পেতো না। কিন্তু পরের দিকে যুদ্ধ যখন আরও ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী যখন গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া শুরু করে। সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে তখন যুদ্ধ হয়ে ওঠে অনেক কঠিন।
সেই কঠিনেরেই ভালোবেসেছিলেন তিনি। দেশের জন্য একটি স্বাধীন পতাকার জন্য প্রাণতো আগে থেকেই ছিলো আকুল। তাই যুদ্ধে যাওয়ার গল্পটিও তার অন্যরকম।
বললেন, ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর বুঝে গেলাম এখন যুদ্ধই একমাত্র পথ। ২৫ মার্চ রাতের পর আর থেমে থাকার সুযোগ ছিলো না। প্রায় তিন সপ্তাহ ঢাকার বাইরে থাকতে হলো। এরপর কারফিউ একটু শিথিল হলে ঢাকা ফিরলাম। আর পরিকল্পনা শুরু করলাম, কিভাবে যুদ্ধে যাওয়া যায়।
বন্ধুদের সবাইকে এক এক করে যোগাড় করলেন। সবাই জড়ো হলেন মায়ার (মোফজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া) বাসায়। সেখানে মিটিং হলো।
গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, ‘তখন শুনলাম ফোর্থ বেঙ্গল ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে আগড়তলা গেছে। আমরাও প্ল্যান করলাম ওখানেই যাবো। মায়ার বাড়ি ছিলো মতলব। সেখান থেকে দাউদাকান্দি হয়ে চান্দিনা হয়ে আমরা আগড়তলা পৌঁছালাম।’
পুরো পথটিই পায়ে হেঁটে গ্রামের পথ ঘেঁটে ঘেঁটে তাদের যেতে হয়েছিলো। সেখানে কলেজটিলা পৌঁছে বাঙালিদের খোঁজ মিললো। চার দিন লেগে গিয়েছিলো তাদের সেখানে পৌঁছুতে। দীর্ঘ সময় পেটে দানাটিও পড়েনি। সেখানে গিয়ে ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খেতে পেলেন।
‘ডিমভাজি দিয়ে ভাত আহা সে কি মজা!’ মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন দস্তগীর গাজী। যেনো এখনও অনুভব করেন সেই দীর্ঘ ক্ষুধার দিনগুলো শেষে সামান্য ডিমভাজা দিয়ে ভাত খাওয়ার তৃপ্তিটুকু।
সামান্যে এই তৃপ্তি ছিলো বলেই সকল যাতনাকে তুচ্ছ করে, ভয়কে জয় করে তারা যুদ্ধ করতে পেরেছিলেন।
গোলাম দস্তগীর গাজী জানালেন, আগড়তলায় তারা মতিনগর ক্যাম্পে চলে যান। সেখানে দেখতে পান খালেদ মোশাররফ ক্যাম্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই ক্যাম্পেই তারা শুরু করেন যুদ্ধ কৌশলের প্রশিক্ষণ।
খালেদ মোশাররফ যখন জানতে পারলেন তারা ঢাকা থেকে গেছেন, তখন বলে উঠলেন, ‘আমিতো ঢাকার ছেলেদেরই খুঁজছি। তোমাদের মতো স্মার্ট ছেলেদেরেই খুঁজছি,’ জানান গোলাম দস্তগীর।
কৌশলটি ছিলো- ঢাকার ছেলেরাই ঢাকায় যুদ্ধ করতে পারবে। গ্রামের ছেলেরা ঢাকায় গেলে খুঁজে পাবে না। খালেদ মোশাররফ তাই করলেন।
আমি, মায়া, বদি, আজাদ, রুমি, ফতেহ, সাঈদ, হাবিবুল আমরা সবাই একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিলাম। আর আমাদের ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়া হলো, বলেন গোলাম দস্তগীর গাজী।
হাতে যখন অস্ত্র পেয়ে গেলাম, আমাদের শরীরে যেনো এক অন্যরকম শক্তি এসে পড়লো, বললেন এই যুদ্ধজয়ী বীর।
তিনি বলেন, আমরা স্টেনগান, এসএলআর চালানো শিখে গেলাম। আর মূলত শিখলাম বিষ্ফোরক, ডেটোনেটর বহন ও তার ব্যবহার।
যুদ্ধ করার প্রগাঢ় মনোবলের পাশাপাশি এবার যুক্ত হলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শক্তি। সঙ্গে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। এই তারুণ্যকে আর ঠেকায় কে? এরপর কত যে ছোট-বড় যুদ্ধ করতে হয়েছে। প্রায় দিনই কোনও না কোনও অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। তারাই ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে সাহসী ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য।
তারই একটি অপারেশন ছিল ১৯৭১ এর ১৯ জুলাই। সেদিন ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধারা উপদলে বিভক্ত হয়ে ঢাকায় একযোগে কয়েকটি অপারেশন করেন। গোলাম দস্তগীর গাজী ছিলেন এই অপারেশনের সম্মুখ ভাগে।
সে রাতে গাড়ি নষ্ট থাকায় রেক্সিনের ব্যাগে বিস্ফোরক ভরে নিয়ে রিক্সায় চেপে এই অপারেশনে যান তারা। তিন রিক্সায় দুজন করে। দূর থেকে গুলির শব্দ আসছিলো। মানুষ-জন যখন নিরাপদে যাচ্ছিলেন তখন এই মুক্তিযোদ্ধা দলটি ছুটছিলো লক্ষ্যস্থলের উদ্দেশে। গাজী দস্তগীরের পায়ের আড়ালে ভাঁজ করে লুকানো স্টেনগান। হাতে বিস্ফোরকের ব্যাগ। রামপুরা ডিআইটি সড়ক থেকে রিকশা ছোটে উলনের পথে। রাস্তায় আলো নেই। অসমান কাঁচা রাস্তায় রিকশা এগিয়ে যায়। লক্ষ্যস্থল উলন বিদ্যুৎকেন্দ্র (সাবস্টেশন)। সেখানে যখন গাজী ও নিলু পৌঁছান ততক্ষণে সঙ্গীরা পৌঁছায়নি।
রিকশা আগে ফটকের সামনে যায়। ফটকে তখন পাহারায় ছিল একজন রাইফেলধারী পুলিশ ও বিদ্যুকেন্দ্রের একজন নিরাপত্তাপ্রহরী। গোলাম দস্তগীর গাজী ও নীলু ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চলন্ত রিকশা থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের দিকে স্টেনগান তাক করেন। পুলিশ রাইফেল মাটিতে ফেলে নিঃশব্দে হাত তোলে। নিরাপত্তাপ্রহরী পালানোর চেষ্টা করলে নীলু পথ রোধ করেন। সহযোদ্ধারা ততক্ষণে পৌঁছে যান। দ্বিতীয় রিকশায় থাকা মতিন দ্রুত টেলিফোনের তার কেটে দেন। ১৫-১৬ জন পুলিশ ও নিরাপত্তা-কর্মী একটি বড় ঘরে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। যোদ্ধারা সেদিকে ছুটে যান এবং সবাইকে নিঃশব্দে আত্মসমর্পণ করান। তাদের নিরস্ত্র করে নীলু ও মতিন পাহারায় থাকেন। গাজী ও মতিন স্টেনগান হাতে এগিয়ে যান ট্রান্সফরমারের দিকে। ট্রান্সফরমার ছিল কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা। প্রায় দোতলাসমান উঁচু ট্রান্সফরমার। অপারেটর রুমের ভেতর দিয়ে সেখানে যেতে হতো। গাজী, মতিন (এক) ও আরও দুই সহযোদ্ধা ভেতরে ঢুকে ট্রান্সফরমারের গায়ে পিকে (বিস্ফোরক) লাগান। এর কিছুক্ষণ পরেই গোটা রামপুরা তথা ঢাকা শহর কাঁপিয়ে বিষ্ফোরিত হয় ট্রান্সফরমার। গোটা এলাকায় অন্ধকার নেমে আসে আর মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে শটকে পড়েন।
যুদ্ধ করতে হলে, জয় করতে হলে বেঁচে থাকতে হবে সেটেই ছিলো তাদের অন্যতম কৌশল, বলেন গোলাম দস্তগীর গাজী।
ছোট বড় অনেক সম্মুখযুদ্ধও করেছেন তিনি। বলেন, ছোট বড় অনেক যুদ্ধই করি। তবে ইছাপুরের যুদ্ধ, ত্রিমোহনীর যুদ্ধ ছিলো বেশ মনে রাখার মতো।
৩ ডিসেম্বরের কথা বলছিলেন। বলেন, বালুনদীর কাছে ত্রিমোহনীতে অবস্থান নিয়ে দেখতে পাই আকাশে যুদ্ধ হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে একটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলো। বুঝতে পারলাম ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে এই যুদ্ধ চালাচ্ছে। আর এও বুঝতে পারলাম পাল্টা হামলা হচ্ছে। এবার পাকিস্তানিদের হারার পালা।
৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনারা ত্রিমোহনীতে আক্রমন করে। গাজী দস্তগীর বলেন, এবার আর আমরা ব্যাকফুটে গেলাম না। গুলি চালাতে চালাতে সামনে এগিয়ে গেলাম। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটলো। আমাদের এই আক্রমনে ১২/১৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। নিহতদের পড়ে থাকা চাইনিজ রাইফেল গুলো আমরা নিয়ে নিলাম। তখন আমাদের সেকি আনন্দ। চাইনিজ রাইফেলে যুদ্ধ করা আরও আনন্দের ছিলো।
চারিদিকে তখন জয়ের পালা শুরু। একের পর এক এলাকা মুক্ত হওয়ার খবর আসছে। ১৩ই ডিসেম্বর আমরা রূপগঞ্জ স্বাধীন ঘোষণা করলাম। রূপগঞ্জ পুরোপুরি নিজেদের দখলে নিলাম।
এরপরের তিন দিন আসলে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের অপেক্ষা।
অবশেষে এসে যায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। আর সেই দিনই বিজয়ী বীর গোলাম দস্তগীর গাজী ছুটে যান নিজের বাসার দিকে। গলির মুখে বাবাকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
যুদ্ধ জয় শেষে ঘরে ফিরে এলে সবারই ভালো লাগে, কিন্তু গাজী দস্তগীরের, সবার প্রিয় গাজী ভাইয়ের সে রাত মোটেই ভালো কাটেনি। রাতে যখন একে একে জানতে পারলেন বদি নেই, ফেরেনি। রুমি ফেরেনি। আজাদ ফেরেনি। জুয়েলের খোঁজ নেই। আলতাফ মাহমুদের পরিবার এসে জানালো তারও খোঁজ নেই।
রাতে আর কোনও সুযোগ ছিলো না… পরের দিন সকালে বের হলেন জুয়েল, আজাদ, বদি, রুমিদের খোঁজে। সে খোঁজা আজও শেষ হয়নি। এখনও এক আকুল মুক্তিসেনা অপেক্ষায় থাকেন তার সহযোদ্ধাদের। তাদের কথা বলতে গিয়ে বুক খালি হয়ে আসে। কণ্ঠ ভারি হয়।